ঘুরে আসুন
কাবার দেশে সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রশান্তি পেতে- সমস্ত মানুষের
হেদায়েত এবং বরকতময় নিদর্শন স্বরূপ মক্কাতুল
মুকাররমায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইতুল্লাহ কাবা। পৃথিবীর গোল্ডেন রেশিও কাবাই সমস্ত পৃথিবীবাসীর ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু
বা কেবলা।কাবাতেই রয়েছে এমন একটি স্থান যেখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করলে তা নিশ্চিত রূপে
কবুল হয়ে যায়। তাই এটি জগৎবাসীর জন্য রাহমাত ও বরকতময় ঘর।
কাবার অর্থ : -
কাবা শব্দটি আরবী
যার অর্থ উঁচু স্থান। মক্কা নগরীর বিস্তীর্ণ মরুভূমির মাঝে আল্লাহর এই ঘরটি উঁচু হয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে, এজন্য একে কাবা বলা হয়। আরবিতে উঁচু ঘরকে কাবা বলা হয়।
কাবার অবস্থান: -
বাইতুল্লাহ বা
আল্লাহর ঘর সৌদি আরবের মক্কাতুল মুকাররমার
মসজিদুল হারামে অবস্থিত। এটি পৃথিবীবাসীর বিশেষ
করে মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র ও সম্মানের
স্থান। সালাতের (নামাজের) কেবলা কাবাঘরটি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। বাইতুল
মামুরের ঠিক নিচে কাবাঘরের অবস্থান।
কাবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন: -
পবিত্র কাবা ঘর
কখন নির্মিত হয়েছিল এ বিষয়ে কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুসারে, মহান
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে ফেরেশতারাই সর্বপ্রথম কাবা ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
করেছিলেন।
এ সুন্দর পৃথিবীর
সূচনা হয় কাবাঘর নির্মাণের মাধ্যমে।নমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর ঘরকে লক্ষ্য করে
বলেন
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ
অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই
সর্বপ্রথম ঘর কাবা, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, যা বাক্কায় ( নগরীতে) অবস্থিত এবং সমস্ত মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’
(সূরা ইমরান:
৯৬)।
কাবা ঘর নির্মাণের ইতিহাস : -
তফসিরবিদদের মতে,
মানব সৃষ্টিরও বহু আগে মহান আল্লাহ রাব্বুলআলামীন কাবাঘর সৃষ্টি করেন। তাফসিরবিদ মুজাহিদ
এর মতে,'আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত বাইতুল্লাহর স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দু’হাজার বছর
আগে সৃষ্টি করেন।’
মুসলিম শরিফে
হজরত আবু-যর গিফারি(রা.) হতে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল (সা.) তাঁর একটি প্রশ্নের উত্তরে
বলেছিলেন, "বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ হলো মসজিদে হারাম কাবা। ২য় মসজিদ হলো মসজিদে
আকসা। মসজিদে হারাম কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পরে মসজিদে আকসা নির্মিত হয়েছিল"।
কাবা সংস্কারের ইতিহাস : -
১) বাবা আদম আলাইহিস সালাম কাবাঘর আল্লাহর আদেশে পুনর্নির্মাণ
করেন। আল্লাহর বান্দারা
কাবাঘর জিয়ারত করতেন, আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতেন এবং কাবাঘরে উপস্থিত হয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্রতা ও অংশীদারহীনতার ঘোষণা দিতেন- "লাববাইক
আল্লাহুম্মা লাববাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা, লাকাওয়াল মুলক, লাশারীকা, লাকা লাববাইক"।
২) এরপর হজরত
শিষ আলাইহিস সালাম কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করলেন।
দিন দিন আল্লাহর আবেদ একত্ববাদীর সংখ্যা বাড়তে
লাগলো ।
৩) এরপর হজরত
ইব্রাহিম (আ.) পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-কে সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ
করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর সংস্কারের পর আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন-
﴿وَاِذۡ يَرۡفَعُ اِبۡرٰهِـمَ الۡقَوَاعِدَ مِنَ الۡبَيۡتِ وَاِسۡمٰعِيۡلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآؕ اِنَّكَ اَنۡتَ السَّمِيۡعُ الۡعَلِيۡمُ﴾
অর্থ- আর স্মরণ
করো, ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এই গৃহের (কাবা)প্রাচীর নির্মাণ করছিলেন, তারা দোয়া করে
বলছিলেন, “হে আমাদের রব! আমাদের এই খিদমত কবুল করুন। আপনি সবকিছু শ্রবণকারী সর্ব জ্ঞাত ।
﴿ رَبَّنَا وَاجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِنۡ ذُرِّيَّتِنَآ اُمَّةً مُّسۡلِمَةً لَّكَ وَاَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۚ اِنَّكَ اَنۡتَ التَّوَّابُ الرَّحِيۡمُ﴾
হে আমাদের রব!
আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (নির্দেশের অনুগত) বানিয়ে দিন। আমাদের বংশ থেকে এমন একটি
জাতির সৃষ্টি করুন যে হবে তোমার মুসলিম। আপনার
ইবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দিন এবং
আমাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দিন। আপনি বড়ই ক্ষমাশীল
ও অনুগ্রহকারী।
﴿رَبَّنَا وَابۡعَثۡ فِيۡهِمۡ رَسُوۡلاً مِّنۡهُمۡ يَتۡلُوۡا عَلَيۡهِمۡ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الۡكِتٰبَ وَالۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيۡهِمۡؕ اِنَّكَ اَنۡتَ الۡعَزِيۡزُ الۡحَكِيۡمُ ﴾
হে আমাদের রব!
এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতির মধ্য থেকে এমন
একজন রসূল পাঠান যিনি এদেরকে আপনার আয়াত পাঠ
করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং এদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত
করবেন। অবশ্যি আপনি মহা শক্তি শালী ও জ্ঞানবান।
আল্লাহ রাববুল
ইজ্জত হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং হজরত ইসমাঈল
(আ.) এর বংশ হতেই হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে শেষ নবি ও রাসূল করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।
৪) শতাব্দীর পর
শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে মুহাম্মাদুর (সা.)-এর
নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর পূর্বে মক্কার বিখ্যাত
কোরাইশ বংশ সংস্কার করেন।
কুরাইশরা কাবা সংস্কারের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা
দিলে সবার সম্মতিক্রমে আল্লাহর রাসূল (সা.) কাবা গৃহে হাসরে আসওয়াদ স্থাপন করে বিরাট
রক্তক্ষীয় যুদ্ধ থেকে আরবদের বাঁচিয়ে দেন। ।
৬) হজরত মুহাম্মাদ (সা.) জীবিত অবস্থায় ৬ হিজরিতে আব্দুল্লাহ
ইবনে জোবায়ের (রা.) বাইতুল্লাহ কাবা সংস্কার
করেন। সর্বপ্রথম নির্মাণ থেকে সর্বশেষ পর্যন্ত
বহু বার কাবা ঘর সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে।
১) সর্বপ্রথম
কাবাঘর ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। এরপর পুনর্নির্মাণ করেন যথাক্রমে: -
২) হজরত আদম (আ.),
৩) হজরত শিষ
(আ.),
৪) হজরত ইব্রাহিম
(আ.),
৫) আমালিকা সম্প্রদায়,
৬) জুরহাম সম্প্রদায়,
৭) কুসাই বিন কিলাব,
৮) মোযার সম্প্রদায়,
৯) মক্কার কুরাইশগণকে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)। হাজরে আসওয়াদকে বর্তমান স্থানে স্থাপন করেছিলেন।
১০) ৬৪ হিজরিতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.),
১১) ৭৪ হিজরিতে
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এবং
১৩) ১০৪০ হিজরিতে
ওসমানিয়া খলিফা তুরস্কের বাদশা চতুর্থ মুরাদ।
এটাই বর্তমান পর্যন্ত কাবাঘরের সর্বশেষ সংস্কার কাজ। এরপর ছোট-খাট
সংস্কার ছাড়া বাইতুল্লাহ কাবার গৃহে আর কেউ হাত দেয়নি।
কাবার গিলাফ: -
কাবার দেয়াল রুপোর ক্যালিওগ্রাফি আঁকা গিলাফ দিয়ে মোড়ানো। আল্লাহর
ঘর কাবার গিলাফ ২০ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ৬
মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রতি বছর নতুন করে তৈরি করা হয়। প্রতি বছর হজের দিন ৯ জিলহজ
ফজরের পরপরই নতুন গিলাফ পরানো হয়। সতর্কতামূলক
দুইটি করে গিলাফ তৈরি করা হয়। একটি হাতে ও অন্যটি মেশিনে। গিলাফগুলো হাতে তৈরী
করতে ৮ - ৯ মাস সময় লাগে । মক্কার উম্মুদ জুদ নামক এলাকায় অবস্থিত একটি বিশেষ কারখানায় গিলাফগুলো তৈরি করা হয়।
কাবার গিলাফের উপকরণ : -
প্রায় ৭০০ কেজি
প্রাকৃতিক রেশম দিয়ে কাবার পবিত্র গিলাফ তৈরী
করা হয়। ৫ টুকরা বিশিষ্ট
গিলাফটির ৪ টুকরা দেয়ালের চারদিকন ও ৫ম টুকরাটি কাবাঘরের দরজায় লাগানো হয়। ১৪ মিটার
উঁচু কালো রঙের এ পবিত্র গিলাফটি সর্বমোট ১৬টি ছোট টুকরা দিয়ে সুবিন্যস্ত। টুকরাগুলো মজবুতভাবে সেলাইযুক্ত।
ক্যালিওগ্রাফি খচিত গিলাফ: -
কাবার গিলাফের
এক-তৃতীয়াংশের ওপর দিকে ৯৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের বন্ধনীতে সোনার প্রলেপকৃত রুপার সুতা
দিয়ে কারুকার্যশোভিত আল্লাহর নাম ও কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিওগ্রাফি খচিত করা হয়।
আরো লেখা থাকে لا
اله الا الله محمد الرسول الله
سبحان الله بحمده ، سبحان الله العظيم
কাবায় গিলাফ পরানোর প্রচলন : -
হিজরতের ২২০ বছর
পূর্বে বাদশাহ তুব্বা আবি কারব আসাদ এ গিলাফের প্রথম প্রচলন করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের
পর মুহাম্মাদ (সা.) এবং হজরত আবু বকর (রা.)
কাবা শরিফে গিলাফ পরিয়ে দেন। এরপর থেকে মুসলিম খলিফা এবং শাসকেরা এ ধারা অব্যাহত রেখে
চলেছেন। এ ছাড়াও নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম পবিত্র
কাবার গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের জননী নুতাইলা।
কাবার গিলাফ পরানোর পদ্ধতি: -
প্রতি বছর হজের
মওসুমের পূর্বে পবিত্র কাবাঘরের অভ্যন্তরে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করে অতি মূল্যবান সুগন্ধি
মেশক আম্বর ও উদ ছিঁটানো হয়। সৌদি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মক্কার সম্মানিত গভর্নরের
নেতৃত্বে হারামাইনের ইমাম ও মুয়াজজিনের অংশগ্রহণে এ কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়ে থাকে
। কখনো কখনো সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণও এই মহতি কাজে অংশগ্রহণের
সুযোগ পেয়ে থাকেন।
উপসংহার : -
পৃথিবীর গোল্ডেন রেশিওতে অবস্থিত বাইতুল্লাহ বিশ্ব মানবতার
জন্য বরকতময় ও হেদায়েতের স্থান। মক্কাতে কাবা ঘর জিয়ারতের সুযোগ পাবেন শুধুমাত্র
মুসলিমরাই।জীবনকে প্রশান্ত করতে ঘুরে আসুন কাবার দেশে। হাজরে আসওয়াদকে চুমু দিয়ে
মুছে ফেলুন জীবনের সকল পাপরাশি।
পোস্ট ট্যাগ -
কাবা শরীফের ইতিহাস
, কাবা শরিফের ছবি , কাবা শরীফের সর্বশেষ নির্মাতা কে , কাবা শরীফ কতবার নির্মিত হয়
, কাবা শরীফের ভিতরে কি আছে , কাবা ঘর কিসের তৈরি , কাবা শরীফের দৈর্ঘ্য প্রস্থ কত
, কাবা শরিফ কে নির্মাণ করেন